ধর্ম কি?
ধর্ম কি?
যে আচরণ পালন করে জীবনে উন্নতি তথা আধ্যাত্মিক জগতকে জেনে পরমকল্যাণ কারী শাশ্বত সুখের প্রাপ্তি হয়, তাকেই ধর্ম বলা হয় ।
![]() |
ধর্ম কি? |
‘বিবেকচূড়ামণি’তে আদি শঙ্করাচার্য বলেছেন,
শব্দজালং মহারণ্যং চিত্তভ্রমণকারণম্
(বিবেক চূড়ামণি - ৬০)
শব্দের জাল ঘন জঙ্গলের মতই যা আমাদের চিত্তকে পথ ভ্রমিত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায় । জীবনের রহস্যের উদ্ঘাটন শব্দের দ্বারা হতে পারে না । এজন্য ব্রহ্মকে জানার জন্য জিজ্ঞাসা যার মধ্যে রয়েছে, তার কেবল আত্ম তত্ত্বেরই অনুভূতি প্রাপ্ত করার প্রয়াস করা উচিত । শব্দের কাজ হল আমাদের অন্তরে কেবল জিজ্ঞাসা উৎপন্ন করা । যেমন ভোজনের চর্চা আমাদের কেবল ক্ষুধা জাগিয়ে দিতে পারে কিন্তু মেটাতে পারে না । খিদে মেটাবার জন্য খাবার খাওয়ার প্রয়োজন হয় ।
আগস্টাইন নামের এক সন্ত ছিলেন, যার অন্তরে বুদ্ধির দ্বারা সমস্ত রহস্য উদ্ঘাটন করার লালসা ছিল । কিন্তু এই বুদ্ধি তো সংসারের রসের বোধ করাতেও পূর্ণরূপে সমর্থ নয়, তাহলে প্রভুর অলৌকিক রসের অনুভূতির সে কী জানবে ? আগস্টাইন বুদ্ধির দ্বারা ঈশ্বরীয় সত্ত্বাকে জানার প্রয়াস করছিলেন, কিন্তু তাতে তিনি সফল হন নি । তিনি নিজের বুদ্ধির গণ্ডির সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছিলেন ।
আইনস্টাইন নিজের আপন চিন্তায় ডুবে একদিন সমুদ্রতটে ভ্রমণ করছিলেন এমন সময় এক বালকের কান্নার আওয়াজ শুনতে পান । তিনি দেখেন হাতে একটি পাত্র নিয়ে বসে এক বালক কাঁদছে । তিনি সেই বালকের কাছে যান । কাছে গিয়ে তাকে প্রেম-পূর্বক ডেকে কারণ জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেন এখানে বসে কান্না করছ কেন ? উত্তরে বালকটি বলে ওঠে, আপনি আমার সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না, এই কথা বলে সে পুনরায় কান্না শুরু করে । একথা শুনে আইনস্টাইন আশ্চর্যচকিত হন এবং কোনোরকমে সেই বালককে কান্না থেকে বিরত করিয়ে তাকে আবার প্রশ্ন করেন, আগে বলতো তোমার সমস্যাটা কী ? হতে পারে কোনো না কোনো সমাধান বের করা যাবে । তখন সেই বালক বলে, আমি এই সমুদ্রকে আমার হাতে ধরা এই পাত্রের মধ্যে পুরে রাখতে চাই । বালকের মুখে এই কথা শুনে আইনস্টাইন জোরে জোরে হেঁসে ফেলেন । তিনি বলেন তুমি ঠিকই বলেছ তোমার এই সমস্যার বাস্তবিকই কোনো সমাধান নেই । এত বিশাল জলরাশির এই সমুদ্র তোমার হাতের এই ছোট্ট পাত্রে কীরূপে ধরবে ? একথা বলে তিনি হাঁসতে হাঁসতে এগিয়ে চললেন । কয়েক পা এগিয়েই তিনি থমকে দাঁড়ান এবং ভেবে আশ্চর্য হয়ে যান যে এটাই তো আমারও সমস্যা । আমিও তো আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধির দ্বারাই সেই অনন্ত ঈশ্বরীয় সত্ত্বার ভেদ জানতে চাইছি । একই সমস্যা নিয়ে আমিও তো ঘুরে বেড়াচ্ছি ।
আপনে দিল মেঁ এসী আহ এসী চাহ পৈদা কর ।
কি ওহ আনে কে লিয়ে মজবুর হো জাএ ।।
শব্দ জালের আবশ্যকতা নেই বরং হৃদয়ে পিপাসা জাগানোর আবশ্যকতা রয়েছে । নিজের হৃদয়ে এমন তীব্র উৎসুকতার জন্ম দাও এমন চাহিদার জন্ম দাও যাতে সেই পরম ঈশ্বরীয় সত্ত্বা স্বয়ং আমাদের মার্গ দেখানোর জন্য বাধ্য হন ।
এই ঘটনার পর এক সন্তের সাথে আইনস্টাইনের দেখা হয়, যার দ্বারাই তিনি সত্যের প্রাপ্তি করেন । যখন তিনি সেই জ্ঞান চক্ষু পান, যার দ্বারা তাঁর হৃদয় মাঝে প্রভুর দর্শন হয়, তখন আইনস্টাইন বলে ওঠেন “হে প্রভু ! আমি এক পথভ্রষ্ট ভেড়ার মতো প্রাকৃতিক ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তোমায় কেবলই বাহ্য জগতে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, না জানি কোথায় কোথায় ঘুরেছি, অথচ তুমি তো আমার হৃদয়েই বিরাজমান ছিলে । বাস্তবিকতা না জানার কারণে তোমায় সংসারের মাঝেই খুঁজে বেরিয়েছি, এখন আমি জানতে পারলাম যে তুমি তো সদা সর্বদা আমার ভীতরেই নিবাস কর ।” এভাবেই মানবজাতিও জ্ঞানচক্ষু অর্থাৎ দিব্যনেত্র না পাবার কারণেই বাহ্য জগতে পথভ্রষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেখানে সেই আনন্দ তো মনুষ্যের হৃদয়েই অবস্থান করছে ।
নেরৈ নাহী দুরি । নিজ আতমৈ রহিআ ভরপুরি ।।
(গুরবাণী – ৬৫৭)
নামদেবজী বলেন, সেই প্রভু আমাদের অত্যন্ত নিকটে রয়েছেন, দূরে কোথাও নেই । সেই দিব্য শক্তি তো আমাদের আত্মাতেই পূর্ণরূপেন বিরাজমান রয়েছেন । সত্য, সৌন্দর্য, শান্তি, শক্তি এবং বিবেক ইত্যাদি এসব কিছু হল পরমাত্মারই গুন । নির্গুণ হওয়া সত্ত্বেও সে জীবকে এরকম গুণের দ্বারাই জীবনে আনন্দের অনুভূতি করিয়ে দেন ।
যখন মনুষ্য ধর্মের মার্গে অগ্রসর হয় তখনই সে জীবনে প্রকৃত সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি প্রাপ্ত করতে পারে । শাস্ত্রে বলা হয়েছে-
ধৃতিঃ ক্ষমা দমোস্তেয়ং শৌচমিন্দ্রিয়নিগ্রহঃ ।
ধীর্বিদ্যা সত্যমক্রোধঃ দশকং ধর্ম লক্ষণম্ ।।
ধর্মের দশটি লক্ষণের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তির মধ্যে ধৈর্য, ক্ষমা, মনের সংযম, চুরি না করা, পবিত্রতা, ইন্দ্রিয়ের সংযম, শুভ কর্ম দ্বারা শুভ বুদ্ধি, মন বাণী ও কর্মের একতা, উত্তম বিদ্যা, ক্রোধ না করা ইত্যাদি গুণসমূহ আসে অর্থাৎ যে মনুষ্য ধর্মকে জেনে যায়, সেই মনুষ্যের ভিতরে এই লক্ষণগুলি আপনা থেকেই প্রকট হয় । ধর্মের পথে চলতে চলতে ব্যক্তি নিজে থেকেই এই লক্ষণগুলি ধারণ করে । মনুষ্য শরীর হল এক পবিত্র মন্দির । যার মধ্যে পরমেশ্বর নিজের সম্পূর্ণতার সাথে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন । গুরবাণীতে বলা হয়েছে –
সগল সমিগ্রী একসু ঘট মাহি । অনিক রঙ্গ নানা দ্রিসটাহি,
নউ নিধি অঁম্রিত প্রভ কা নামু । দেহি মহি ইস কা বিস্রামু ।।
(গুরবাণী - ৫/২৯৩)
সুখমনী সাহিবে শ্রীগুরু অর্জুনদেব বলেন, সমস্ত সামগ্রী এই শরীরের ভেতরেই বিদ্যমান । সেটা একই শক্তি যা নানা প্রকার রঙ্গে দেখা যায় । পরমাত্মার শাশ্বত নাম যা কিনা অমৃতের সমান, এই শরীরেই বিদ্যমান । সেই পরমানন্দ সুখ ও শান্তি প্রদানকারী পরমেশ্বরকে, নিজের পূর্ণতার সাথে এই শরীরের দ্বারাই প্রাপ্ত করা যেতে পারে । অতঃ বলা হয় যে – “শরীরমাধ্যং খলুধর্ম সাধনম্” অর্থাৎ মানব তন হল ধর্মের সাধনের মাধ্যম । এই মানব শরীরের দ্বারাই ধর্মের প্রাপ্তি সম্ভব । ধর্মের সম্বন্ধ কেবল বাহ্য লক্ষণের সাথে নয় । কেবল বাহ্য কর্মদ্বারা আমরা যদি বলি যে ধর্মের পথে চলছি তাহলে তা সত্য নয় । কেবল বাইরের বেশভূষা ধারণ করে নিলেই ধার্মিক হওয়া যায় না । ধর্মের শুরু হয় অনুভবের থেকে । যখন আমরা ঈশ্বরীয় সত্ত্বার ঝলক নিজের মধ্যেই পাই, তখন ধর্মের লক্ষণগুলি ধারণ করে, জীবনে সুখ, শান্তি এবং সমৃদ্ধি প্রাপ্তি করি এবং জীবনে দিব্য শক্তিকে জেনে স্বয়ং-এর পরম কল্যাণ করে নিতে পারি ।
ধরমু না দুসর সত্য সমানা । আগম নিগম পুরান বখানা ।
(রা.চ.মা. – ২/৯৫/৩)
শ্রীরামচরিত মানসে বলা হয়েছে যে সংসারে সত্য ছাড়া অন্য কোন ধর্ম নেই । যত ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ সমূহ ইত্যাদি আছে সব এটাই বলে অর্থাৎ যিনি পরমাত্মাকে হৃদয়ে জেনে নিয়েছেন, দেখে নিয়েছেন, সেই ধার্মিক পুরুষের কর্তব্য হল তিনি ধর্মের পথে অগ্রসর হবেন । কিন্তু যে ব্যক্তি ধর্মহীন তার সম্বন্ধে বলা হয়েছে –
ধর্মেণ হীনাঃ পশুভিঃ সমানাঃ ।
ধর্মকে না জানার কারণেই আজ মনুষ্য পশুবৎ আচরণ করে থাকে । শাস্ত্রে ধর্মহীন ব্যক্তিকে পশুর সমান বলা হয়েছে । কেবল ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেওয়াই মানবের জন্য পর্যাপ্ত নয়, বরং এটা তো একটি সন্দেশ যে ঈশ্বর প্রতিটি অণুতে পরমাণুতে বিদ্যমান রয়েছেন এবং তাঁকে প্রাপ্ত করাও যেতে পারে । সেই ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অনুভব করা যেতে পারে । আমাদের সুখ শান্তির প্রাপ্তি না তো কোনও সম্প্রদায়ের দ্বারা হতে পারে এবং না এটা কোনও মতান্তরের দ্বারা সম্ভব, এসবের দ্বারা মনুষ্য তো আরও ভ্রমিত হয়ে পড়ে কারণ পরমাত্মা বুদ্ধি গম্য নয় । তাঁকে জ্ঞান গম্য বলা হয়েছে ।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্বস্য বিষ্ঠিতম্ ।
(গীতা – ১৩/১৭)
সেই জ্ঞান তো জানার যোগ্য । যিনি সকলের হৃদয়ে সমাহিত রয়েছেন তাঁকে তত্ত্ব জ্ঞানের দ্বারাই প্রাপ্ত করা যেতে পারে ।
কবীরা জহা গিআনু তহ ধরমু হৈ জহা ঝুঠু তহ পাপু ।
জহা লোভু তহ কালু হৈ জহা খিমা তহ আপু ।।
(গুরবাণী - ১৩৭২)
গুরবাণীতে কবীর জী বলেছেন, যেখানে জ্ঞান আছে সেখানেই ধর্ম রয়েছে । ধর্মকে আমরা শব্দের দ্বারা বুঝতে পারি না । শব্দ স্বয়ং পূর্ণ না হওয়ার কারণে আমাদের সত্য পর্যন্ত নিয়ে যেতে সক্ষম নয় ।
যখন সেই ঈশ্বর আমাদের অন্তরেই প্রকট হন, তখন এই সদগুন সমূহ স্বতঃ পরিলক্ষিত হতে থাকে । আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাংসারিক কার্য ও আপনা থেকেই সার্থক হতে থাকে এবং তখনই আমাদের জন্য মনুষ্য জীবন সার্থক সিদ্ধ হতে পারে । আমরা তখন মৃত্যু থেকে অমরত্ত্বের দিকে অগ্রসর হই । বলা হয় যে ‘জীব কর্মের দ্বারা বাঁধা পড়ে এবং জ্ঞানের দ্বারা মুক্ত হয়’ জ্ঞানই হল মুক্তির একমাত্র উপায় । কিন্তু আজকাল জগতে জ্ঞানের সম্বন্ধে অনেক প্রকারের ভ্রান্তি ছড়ানো রয়েছে পরিলক্ষিত হয় । কেউ কেউ কোনো কর্মকেই জ্ঞান বলে থাকে, আবার কেউ-বা কোনো মার্গকেই জ্ঞান ভাবে । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যখন জ্ঞান দেন তখন বলেন যে –
ইদং তু তে গুহ্যতমং প্রবক্ষ্যাম্যনসুয়বে ।
জ্ঞানং বিজ্ঞানসহিতং য়জ্জাত্বা মোক্ষ্যসেওশুভাৎ ।।
(গীতা – ৯/১)
অর্থাৎ হে অর্জুন ! আমি তোমায় দোষ দৃষ্টি থেকে রহিত, অত্যন্ত গোপনীয় জ্ঞানের বিজ্ঞান সহিত অনুভব করাবো যাকে জেনে তুমি পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে । তারপর আগে বলেছেন যে –
রাজবিদ্যা রাজগুহ্যং পবিত্রমিদমুত্তমম্ ।
প্রত্যক্ষাবগমং ধর্ম্যং সুসুখং কর্তুমব্যয়ম্ ।।
(গীতা – ৯/২)
এই জ্ঞান হল সমস্ত বিদ্যার মধ্যে রাজবিদ্যা, অত্যন্ত গোপনীয়, পবিত্র এবং শ্রেষ্ঠ । এই জ্ঞান প্রত্যক্ষ অনুভবের দ্বারাই প্রাপ্ত করা যায় । যে জ্ঞানের অনুভবের জন্য কোন প্রকারের মাধ্যমের প্রয়োজন নেই, তা ইন্দ্রিয় ছাড়াই অনুভব গম্য, যা কিনা ধর্মের অনুকূল । এই জ্ঞান সমস্ত সুখ প্রদানকারী, করা অত্যন্ত সরল, এবং অব্যক্ত । আমাদের প্রয়োজন হল এই মহান জ্ঞানকে প্রাপ্ত করা । যে জ্ঞান ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রদান করেছিলেন, সেই জ্ঞানই হল এটা যা মনুষ্যকে জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি এবং শাশ্বত শান্তি প্রদান করে । এই জ্ঞানের প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজন হল, পূর্ণ সতগুরুর । তাঁর দ্বারাই সত্য মার্গকে জানা যেতে পারে ।
গুরু তিনি নন যে তিনি কোন মন্ত্র দিয়ে দেবেন, কোন নাম জপতে দিয়ে দেবেন অথবা অন্য কোন যুক্তি বলে দেবেন এবং আমরা বলতে থাকবো, আমি তো গুরু ধারণ করে নিয়েছি । এটা উচিত নয় । বরং যতক্ষণ পর্যন্ত সত্য মার্গকে স্পষ্ট করে বলেন এমন গুরু না মেলে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সতগুরুর খোঁজ চালিয়ে যাওয়া উচিত, কারণ জ্ঞানের প্রাপ্তি তো গুরুর দ্বারাই সম্ভব । সত্য জ্ঞান সেটাই যা আমাদের সমস্ত ধর্মগ্রন্থ, বেদ এবং শাস্ত্রে বলা হয়েছে ।
যদি আমাদের শাস্ত্র সম্মত বিধির অনুসারে জ্ঞান না হয়ে থাকে তাহলে এর অর্থ হল এখনো আমাদের গুরুর উপলব্ধি হয় নি । বলা হয়ে থাকে যে ব্যক্তি দুই নৌকায় পা দেয় সে ডুবে যায় । ভেবে দেখার বিষয় হল অসুস্থ হলে আমরা এক ডাক্তারের কাছে ঔষধ নিই এবং যদি রোগ ঠিক না হয় তাহলে শীঘ্রই ডাক্তার বদলাই, যেখানে এই শরীর তো মরণশীল । একদিন না একদিন এর মরণ হবেই । তা সত্ত্বেও এর রক্ষার জন্য আমরা কতই না প্রয়াস করি, কত চিন্তা করি, কী রকমভাবে ডাক্তারের খোঁজ করি । সেই রকম যদি পূর্ণ গুরুর প্রাপ্তির প্রয়াসে অসফল থাকা কালীন জীবন সমাপ্ত হয়ে যায় তাহলে না জানি কতদিন অন্য যোনীসমূহে ঘুরে বেড়াতে হবে । এইজন্য বুদ্ধিমত্তার পরিচয় সেখানেই যে যদি আমরা জানতে পারি, যে নৌকাটিতে আমি বসে আছি তার তলায় ছিদ্র রয়েছে এবং তা আমাদের ডুবিয়ে দেবে, তাহলে এক মুহূর্তও দেরী না করে তখনই সেই নৌকা ছেড়ে অন্য নৌকায় গিয়ে বসা, যেটা আমাদের নদী ওপাড়ে নিয়ে যেতে পারে । এরকমই ভবসাগর পার করার জন্য প্রয়োজন হল এক ‘পূর্ণ-সতগুরুর’। মহাপুরুষগণ বলেছেন –
জব তক গুরু মিলে নহীঁ সাচা । চাহে করো দস য়া করো পচাসা ।।
যতক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকারের গুরু না মেলে ততক্ষণ পর্যন্ত দশটি কেন পঞ্চাশটি গুরু করতে হলেও প্রয়াস চালিয়ে যাও ।
এরকম আজকের দিনেই নয় পূর্বেও এই নিয়ম ছিল । বিবেকানন্দের সাথেও এরকমই হয়েছিল । তিনিও অনেক গুরুর কাছে গিয়েছিলেন কিন্তু তারা সবাই ছিলেন নামেরই গুরু । ধ্যান-জ্ঞানের সঙ্গে অনেক দূর পর্যন্ত তাদের কোনোরকম সম্পর্কই ছিল না । এভাবে পূর্ণগুরুর খোঁজ করতে করতে বিবেকানন্দ(পূর্ব নাম নরেন্দ্র)-এর হৃদয়ে পরমাত্মার উপর থেকে বিশ্বাস ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে । একদিন তার এক বন্ধু বলেন যে নরেন্দ্র ! আমাদের ঘরে এক সন্ত মহাপুরুষ আসবেন, উনার সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব । এদিকে নরেন্দ্রর মধ্যে সন্তদের প্রতি সম্পূর্ণ অন্যরকম ধারনার জন্মেছিল । সন্তের নাম শুনেই নরেন্দ্র জবাব দেন আপনার ঘরে সন্ত আসছেন, ব্যস এজন্যই আসতে পারবো না । নরেন্দ্রর মুখে এরকম কথা শুনে বন্ধু অত্যন্ত আশ্চর্য হন । তিনি বলেন যে নরেন্দ্র ! তুমি তো একসময় সন্তদের সাথে মেলামেশার জন্য সর্বদা উৎসুক থাকতে । কিন্তু আজ তোমার কী হল ? কিন্তু নরেন্দ্রের বদলে যাওয়া মেজাজের দিকে লক্ষ করে তার বন্ধু কথা ঘুরিয়ে বলেন । আচ্ছা ভাই বন্ধু হিসেবে আমি তোমাকে ডাকছি । তুমি কী বন্ধুর বাড়ীও আসবে না ? এতে নরেন্দ্রকে সম্মতি দিতেই হয় । তখন বন্ধু বলেন সেই অবসরে তোমাকে একটি ভজন গাইতে হবে । বন্ধুর বাড়ী আসবে তো কিছু না কিছু করতে হবে এবং আমি এটাই চাইবো যে সেদিন তুমি একটি ভজন অবশ্যই গাইবে । নির্ধারিত দিনে নরেন্দ্র বন্ধুর বাড়ীতে গিয়ে হাজির হন । সেখানে স্বামী রামকৃষ্ণ পরমহংসও উপস্থিত ছিলেন । নরেন্দ্র যখন ভজন গাইলেন, তার হৃদয়ে প্রভুর প্রতি বৈরাগ্য তো ছিলই, তখন স্বামী রামকৃষ্ণের দুচোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে শুরু করে । যখন ভজন সমাপ্ত হয় তখন স্বামী রামকৃষ্ণ অত্যন্ত ভাবুক হয়ে যান । এবং তিনি ভাবাবেশে বলেন, নরেন্দ্র ! তুমি এতদিন কোথায় ছিলে ? আমি না জানি কতদিন থেকে তোমার প্রতীক্ষা করছি । কিন্তু নরেন্দ্র সোজা জবাব দিয়ে বলে ওঠে মিষ্টি মধুর কথায় আপনি আমাকে ভোলাতে পারবেন না । আপনার যদি আমার ভজন পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য ধন্যবাদ । কিন্তু আমি আপনার কাছে অবশ্যই প্রশ্ন রাখতে চাই, পরমাত্মা কী আছেন ? তখন রামকৃষ্ণ বলেন “হ্যাঁ পরমাত্মা রয়েছেন ।” তখন নরেন্দ্র বলেন আপনি কী পরমাত্মাকে দেখেছেন ? আপনি কী পরমাত্মাকে জানেন ? তখন স্বামী রামকৃষ্ণ বলেন যে নরেন্দ্র এই সময় আমার সবচেয়ে নিকটে তুমিই দাঁড়িয়ে রয়েছ, কিন্তু আমি তোমার থেকেও নিকটে সেই পরমাত্মাকে দেখছি । নরেন্দ্র বলেন যে আপনি যাকিছু বলছেন তা যে সত্য এর কী প্রমাণ ? তখন রামকৃষ্ণ পরমহংস বলেন তুমিও সেই পরমাত্মাকে জানতে পারো সেটাই হল প্রমাণ ।
তারপর স্বামী রামকৃষ্ণ পরমহংস নরেন্দ্রকে তত্ত্ব জ্ঞান দেন, সেই চক্ষু দেন যাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় দিব্য চক্ষু বলেছেন এই মহান জ্ঞানকে জেনে নেবার পরই নরেন্দ্রকে বিবেকানন্দ নামে পরিচিত হন । তিনি নিজে জীবনে শাশ্বত সুখের প্রাপ্তি করে সেই সত্যের প্রচার করেন । এইজন্যই বলা হয় প্রত্যক্ষের আর প্রমাণের প্রয়োজন হয় না, সেই ঈশ্বর তো হৃদয়েই বসে রয়েছেন । প্রয়োজন হল এমন এক পূর্ণ সদগুরুর যিনি আমাদের নিজের হৃদয়েই প্রভুর দর্শন করিয়ে দেবেন, তাঁর প্রত্যক্ষ অনুভূতি করিয়ে দেবেন । তিনিই হলেন পূর্ণগুরু । অতঃ এই পুস্তক দ্বারা আপনি জানতে পারবেন যে কী প্রকারে পূর্ণগুরুর শরণে পৌঁছে সেই মহান জ্ঞানের উপলব্ধি হতে পারে । যে তত্ত্ব জ্ঞানের চর্চা এই পুস্তকে করা হয়েছে তা কেবল পড়া-শুনা বা কথার কথা নয়; বরং পূর্ণ সদগুরু শ্রী আশুতোষ মহারাজের অসীম কৃপায় আমি এই মহান ‘তত্ত্ব-জ্ঞান’কে জেনেছি সেই তত্ত্বজ্ঞানকে জেনেই মনুষ্য এই জীবনে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি এবং শাশ্বত তত্ত্বকে প্রাপ্ত করেই জীবনকে তো আনন্দময় বানিয়ে নেয়, সেই সাথে নিজের পরলোকও শুধরে নেয় । এই পুস্তকে কোন প্রকারের ত্রুটি থাকলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থী এবং আশা করি পাঠকগণ সেসবের প্রতি বিশেষ মনোযোগ না দিয়ে বাস্তবিকতাকেই জানবার প্রয়াস করবেন । সবার জন্য জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল মহান তত্ত্বজ্ঞানকে প্রাপ্ত করা । অতঃ প্রভুর কাছে আমার এটাই প্রার্থনা,
সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ ।
ধর্
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন