আধ্যাত্ম || অধ্যাত্ম || Adhyatma কি?
অধ্যাত্ম শব্দের অর্থ কি?
আধ্যাত্ম(Adhyatma) শব্দটি দুটি ধাতুর সংযোগে তৈরি হয়েছে। অধ্য (অধ্যায়ন )+ আত্ম (আত্মবিষয়ক) অর্থাৎ আত্মা বা চিত্ত- বিষয়ক; পরমাত্ম বিষয়ক অধ্যায়ন। ইংরেজিতে বলা হয় স্পিরিচুয়াল সাইন্স।
![]() |
আধ্যাত্ম || Adhyatma কি? অধ্যাত্ম শব্দের অর্থ কি? |
অধ্যায়ন সব সময় দুটি ধাপে হয়। প্রথমটি হল থিওরিটিক্যাল এবং দ্বিতীয়টি হল প্র্যাকটিক্যাল অর্থাৎ ব্যবহারিক। থিওরিটিক্যাল পাঠের মাধ্যমে আলোচ্য বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের কিছুটা ধারণা তৈরি করা সম্ভব হলেও ১০০% জানতে হলে ব্যবহারিক প্রয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন। ব্যবহারিক বা প্র্যাকটিক্যাল করার জন্য ল্যাবরেটরী বা প্রয়োগশালা প্রয়োজন। যেখানে শিক্ষক বা সদ্ গুরু এবং শিক্ষার্থী বা শিষ্য এর উপস্থিতি অনিবার্য। এখানে আমরা কেবলমাত্র থিওরিটিকাল পার্ট নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
আধ্যাত্ম পথ চলা শুরু হয় ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে। ব্রহ্ম শব্দের অর্থ ঈশ্বর বা ঈশ্বরকে, জ্ঞান শব্দের অর্থ জানা। কোন কিছু সম্পর্কে শুনলে বা পড়াশোনা করলে সেই বিষয়ে ১০০% জানা হয় না। কোন বিষয়ে নিজের চোখে, বাস্তবে বা ব্যবহারিকভাবে প্রত্যক্ষ করলে বা দেখলে তবেই সেই বিষয়ে ১০০% জ্ঞান সম্ভব।
প্রশ্ন: ব্রহ্মজ্ঞান (তত্ত্বজ্ঞান) কি?
উত্তর: ত্রিনেত্র খুলে অন্তর্জগতে তৎক্ষণাৎ ঈশ্বরের(জ্যোতি বা আলোক বা প্রকাশ স্বরূপ) সাক্ষাৎকার করাই হলো ব্রহ্মজ্ঞান (তত্ত্বজ্ঞান)। এটি ব্যবহারিক জ্ঞান প্রক্রিয়া। এটিকে পরাবিদ্যা বা গুপ্তবিদ্যা বলা হয় যার দ্বারা তৎক্ষণাৎ ঈশ্বর দর্শন সম্ভব। পরোক্ষভাবে বলা যায় যে গুপ্ত পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ার দ্বারা ঈশ্বর (জ্যোতি বা আলোক বা প্রকাশ রূপ ) দর্শন সম্ভব তাকেই ব্রহ্মজ্ঞান বলা হয়।
প্রশ্ন : আমরা দুটি চোখের কথা জানি, বাস্তবে আমাদের কয়টি নেত্র রয়েছে ? ত্রিনেত্র কি এবং এর কাজ কি ?
উত্তর: তিনটি চোখ। একটি চোখের গুরুত্ত্ব দেইনি বলে অধিকাংশই তৃতীয় নেত্র সম্পর্কে ভুলে গেছি। ধারাপাতে ছোট বেলায় পড়ানো হয়েছিল তিনে নেত্র অর্থাৎ তিনটি চোখ। তাছাড়া আমরা ভগবান শিব এবং মা দুর্গার কপালে আরো একটি চোখ দেখি, সেটাই ত্রিনেত্র। সেটি সমস্ত মানুষেরই রয়েছে। সদ্গুরুর কৃপা হস্ত মাথায় পড়লেই ত্রিনেত্রটি খুলে যায় এবং তৎক্ষণাৎ অন্তর্জগতে ঈশ্বর দর্শন হয়। ত্রিনেত্রের দ্বারা পরাবিদ্যা সম্পর্কে অধ্যয়ন ও সম্ম্যক জ্ঞান অর্জন সম্ভব।
দীক্ষা কি ?
দীক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দিক ধাতু থেকে যার অর্থ হলো দেখা অর্থাৎ ঈশ্বর দর্শন করা।
প্রশ্ন : আমি দীক্ষা নিয়েছি কিন্তু কোনো ঈশ্বর দর্শন হয় নি কেন ?
উত্তর : শিক্ষা এবং দীক্ষা এই দুটি শব্দের সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার নেই। কানে আমরা যা কিছু শুনি তার দ্বারা আমরা শিক্ষা লাভ করি। গুরুর কাছে সৎসঙ্গ কানে যা কিছু শুনি তার দ্বারা আমাদের শিক্ষা লাভ হয়। আর চোখে যেটা দেখি তার দ্বারা দীক্ষা লাভ হয়। যদি আমাদের ঈশ্বর দর্শন না হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে আমাদের শিক্ষা অবশ্যই হয়েছে কিন্তু দীক্ষা হয়নি। অর্থাৎ থিওরিটিক্যাল জ্ঞান হয়েছে। ল্যাবরেটরি বা প্রয়োগশালায় যে প্রাকটিক্যাল বা ব্যবহারিক জ্ঞান দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে ঈশ্বর দর্শন সম্ভব, সেই জ্ঞান দেওয়া হয়নি।
প্রশ্ন : ঈশ্বর দর্শন কি আদৌ সম্ভব?
উত্তর : হ্যাঁ ঈশ্বর দর্শন বাস্তবে সম্ভব। আমরা অনেকেই নিচের গুরুমন্ত্রটি উচ্চারণ করে থাকি যার মধ্যে ঈশ্বর দর্শন এর বিষয়ে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে।
অখণ্ড মণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং য়েন চরাচরং । তৎপদং দর্শিতং য়েন তস্মই শ্রী গুরুবে নমঃ ।। এখানে দর্শিতম শব্দটি ঈশ্বর দর্শন সম্ভব তারই ইঙ্গিত করে। শুধুমাত্র এখানেই নয় সমস্ত ধর্ম গ্রন্থেই ঈশ্বর দর্শনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
আসুন আমরা উপরিউক্ত মন্ত্রের অর্থ বোঝার চেষ্টা করি । ‘অখণ্ড’ অর্থাৎ সেই পরমাত্মা যাকে খণ্ডিত বা টুকরো করা যায় না । ‘মণ্ডলাকারং’ অর্থাৎ গোলাকার সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডে, ‘ব্যাপ্তং’ অর্থাৎ ব্যাপ্ত বা সমাহিত রয়েছেন । ‘য়েন’ অর্থাৎ এই ‘চর’ অর্থাৎ সমস্ত জীবের মধ্যে বা ‘অচর’ অর্থাৎ সমস্ত নির্জীব বস্তুর মধ্যে অর্থাৎ গাছপালা ও পশুপক্ষী সব কিছুর মধ্যে যিনি মিলে মিশে রয়েছেন । ‘তৎপদং দর্শিতং য়েন’ আমাদের সেই পরম তত্ত্বের দর্শন যিনি করিয়ে দেন, ‘তস্মই’ অর্থাৎ তাঁকেই, ‘শ্রী’ অর্থাৎ শরীরধারী বা জীবিত(জীবিত ব্যক্তিদের নামের পূর্বে শ্রী লাগানো হয়) ‘গুরুবে’ অর্থাৎ গুরুকে, ‘নমঃ’ অর্থাৎ নমস্কার ।
অর্থাৎ সেই পরমাত্মা যাকে খণ্ডিত করা যায় না । যিনি সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডে ব্যাপ্ত রয়েছেন, সমস্ত জীবিত ও নির্জীব বস্তুর মধ্যে, সৃষ্টির প্রতিটি অণুতে পরমাণুতে বিদ্যমান । যিনি আমাদের সেই পরম তত্ত্বের দর্শন করিয়ে দেন, বলা হয়েছে তিনিই পূর্ণ সদগুরু । দেহধারী সেই গুরুদেবকেই আমার প্রণাম । উনিই হলেন পূর্ণ-গুরু যিনি আমাদের হৃদয়ের মাঝেই সেই পরমাত্মার তত্ত্বরুপের দর্শন করিয়ে দেন । এই মন্ত্রের দ্বারা গুরুর কাজ সম্পর্কে পরিস্কারভাবে বলে দেওয়া হয়েছে । গুরুর কাজই হল ঈশ্বরের দর্শন করানো সেটাই এখানে পরিস্কার করে বলা হয়েছে । সেকারনেই এই মন্ত্রে দর্শিতং শব্দের উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু দর্শন কী প্রকারে হবে সেটাই প্রশ্ন ? এই দুই নেত্র দ্বারা হতে পারে না । চর্ম চক্ষুর দ্বারা অগম অগোচর ঈশ্বরকে দর্শন করা সম্ভব নয়, ঈশ্বর হলেন দিব্য, তাই তাঁকে দেখবার জন্য দিব্যচক্ষু বা ত্রিনেত্র বা ত্রিনয়ন চাই । যে প্রক্রিয়ার দ্বারা দিব্যচক্ষু লাভ করে আমাদের অন্তর জগতেই ঈশ্বর দর্শনের অনুভব হয় তাকেই ব্রহ্মজ্ঞান বলে ।
ব্রহ্ম জ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
ব্রহ্মজ্ঞান(তত্ত্বজ্ঞান) পেতে আগ্রহী হলে ক্লিক করুন
জগতের সকল পদার্থ ও জীব নিজ নিজ মূল উৎসের সন্ধান করে থাকে । মুল উৎস উৎস থেকে যে যত দূরে থাকে সে ততই অশান্তি ও অস্থিরতার মধ্যে সময় ব্যতীত করে । নিজের উৎসকে খুঁজে পেলে তবেই সে প্রকৃতভাবে ধির, স্থির ও শান্ত হতে পারে । যেমন জলের উৎস হল সমুদ্র । মেঘের প্রলভনে জল বাষ্পীভূত হয়ে উপরে উঠে । বাদল হয়ে যখন সে অন্যত্র দূরে কোনও পর্বত শিখরে বৃষ্টি বিন্দুরূপে ঝরে পড়ে এবং তখন বুঝতে পারে সে সমুদ্র থেকে আলাদা হয়ে পড়েছে এবং তখন থেকেই তার মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি হয় । সে জানে সমুদ্র থেকে আলাদা হবার সময় আমি নীচ থেকে উপরে উঠে এসেছিলাম তাই এখন নীচের দিকে ধাবিত হলে তবেই সমুদ্রকে পুনরায় পাওয়া যাবে এবং সেখানে পৌঁছাতে পারিলেই শান্তি ও স্থিরতা আসবে । তাই জল সবসময় তার উৎসকে পাবার জন্য পাহাড় নীচের দিকে ধাবিত হয় । এভাবে জলধারা ততক্ষণ নিম্নমুখে প্রবাহিত হতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না সে পুনরায় তার উৎসস্থল অর্থাৎ সমুদ্রের সাথে মিলিত হতে পারে ।
অগ্নিশিখার মূল উৎস হল সূর্য সমস্ত অগ্নিশিখা জানে যে সূর্যের অবস্থান উপরের দিকে আকাশ মাঝে । তাই সে সবসময় উপরের দিকে ওঠার প্রচেষ্টা করে যাতে সে তার উৎসের সাথে মিলিত হতে পারে । এভাবে প্রত্যেক বস্তু এবং জীব তার উৎসস্থল পর্যন্ত না পৌঁছানো পর্যন্ত অস্থিরতার মধ্যে কাল অতিবাহিত করে ।
জীবাত্মার উৎস হল পরমাত্মা । আত্মা জানে ভৌতিক জগতের বস্তুসকলের মধ্যে চিরসুখ বা শান্তি নেই । সেগুলির প্রাপ্তির সাথে সাথে অদৃশ্য রূপে দুঃখ বেদনা লুকিয়ে থাকে । কিছুকাল অতিবাহিত হবার পরে সেই সমস্ত লুকিয়ে থাকা দুঃখরাশি সামনে আসা শুরু হয় । যেমন উদাহরণ স্বরূপ টিভি কিমবা গাড়ী কেনার পরবরতী দুঃখ রাশি সকল যে কিনেছে সেই কিছুটা বোঝে । বাড়ির কেউ বলে সিরিয়াল দেখব আবার একই সময়ে কেউবা সিনেমা, আবার কেউ খবর একই সময়ে দেখতে চায় । শুরু হয় অশান্তি অন্তঃকলহ । এভাবে বস্তু সকলের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জীব যখন এটা বুঝতে শেখে যে প্রকৃত শান্তি কোথাও নেই । জীব দুঃখ কষ্ট ও অশান্তিতে পড়ে সবশেষে তখন ঈশ্বরকে খোঁজে যাতে সে শান্তি পায় । কারণ ঈশ্বরই হলেন সুখ বা আনন্দের প্রকৃত উৎস । আসুন আমরাও আমাদের সেই উৎস অর্থাৎ ঈশ্বরের সন্ধান করি এবং আমাদের জীবনকে প্রকৃতরূপে সুখ শান্তি ও আনন্দময় করে তুলি । শাস্ত্র বলে ঈশ্বর প্রাপ্তিই হল মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য । ভারতীয় সমস্ত ধর্মশাস্ত্র ও ধর্মগ্রন্থে বিভিন্ন মন্ত্রের দ্বারা সেই পরমাত্মাকে পাবার উপায়, তাঁকে চেনার উপায়, কোথায় গেলে তাঁকে পাওয়া যাবে, কীভাবে তাঁকে পাওয়া যাবে ইত্যাদির সম্পর্কে পরিস্কার ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে । প্রয়োজন হল ধর্মগ্রন্থের মন্ত্রগুলি কেবল তোতাপাখীর মতো না আওড়ে বরং সেগুলির প্রকৃত অর্থ জেনে সেই দিশায় এগিয়ে গিয়ে সেই পরমাত্মোকে প্রথমে জানার এবং পরের ধাপে তাঁকে প্রাপ্তির প্রচেষ্টা করি ।
আজকাল বেশিরভাগ মানুষই ভাবে যে ঈশ্বর দর্শন আদৌ সম্ভব নয়, আবার অনেকে ভাবেন ঈশ্বর দর্শনের জন্য দীর্ঘ সময় ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে ধ্যান বা তপস্যা ইত্যাদি করলে তবে সম্ভব হয় । তাহলে আসুন ধর্মগ্রন্থ ও শাস্ত্রগুলি কী বলছে একটু বিস্তারিত ভাবে পড়ে দেখা যাক ।
এই ব্রহ্মজ্ঞান ছাড়া জীবের মুক্তি অসম্ভব ।
দুর্লভং ত্রইমেবৈতদদেবানুগ্রহহেতুকম ।
মনুষ্যত্ত্বং মুমুক্ষত্ত্বং মহাপুরুষসংশ্রয় ।।
– (বিবেকচুড়ামনি )
বিবেকচূড়ামণিতে আদি শঙ্করাচার্য্য উল্লেখ করেছেন, জগতে তিনটি জিনিস হল দুর্লভ তা হল, এক মনুষ্যতনের প্রাপ্তি, দ্বিতীয়টি হল মুমুক্ষত্ত্ব অর্থাৎ মুক্তির জন্য আগ্রহ এবং তৃতীয়টি হল মহাপুরুষের সান্নিধ্য ।।
ইহচেদবেদীদথসত্যমস্তিন না চেদিহাবেদীন্মহতী বিনষ্টি ।
(বিবেকচুড়ামনি )
এই জীবনেই যদি কেহ সত্যকে জেনে নেয়, অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান(তত্ত্বজ্ঞান) লাভে সমর্থ হয়, তবে তাহার জীবন কৃতকৃত্য ও ধন্য হয় । আর এই জন্মে যদি জ্ঞান লাভ না হয় তাহলে মহতী বিনাশ প্রাপ্তি, বারবার সংসার দুঃখ ভোগ করতে হয় । এই কারনে এই জীবন হল অত্যন্ত দুর্লভ ।
ঘর মহি ঘরু দেখাই দেই সো সতিগুরু সো সতিগুরু পুরখু সুজাণু ।
–(গুরবাণী – ১/১২৯১)
পূর্ণ সতগুরু হলেন তিনিই যিনি আমাদের এই শরীর-রূপী ঘড়ের মধ্যেই পরমাত্মার ঘড়কে দেখিয়ে দেবেন । ‘সুজান’ অর্থাৎ যার নিজের চক্ষু খুলেছে । যিনি হৃদয়েই প্রভুর দর্শন করিয়ে দেন, তিনিই পূর্ণ সতগুরু । গুরুর কার্য হল সেই সত্যকে আমাদের অন্তর্জগতে প্রকট করিয়ে দেওয়া ।
আমরা যদি বাস্তবে ঈশ্বরাকাঙ্খী ভক্ত হই তাহলে অবশ্যই গুরুর কাছে ঈশ্বর দর্শনের দাবী করতে পারি, কেননা ঈশ্বর দর্শন হল প্রতিটি মানুষের জন্মসিদ্ধ অধিকার । গুরু যদি সত্যিকারের পূর্ণ সদগুরু হন, তাহলে অবশ্যই তিনি কোনোরকম শব্দের জ্বালে ভ্রমিত না করে তৎক্ষণাৎ ঈশ্বরের তত্ত্ব স্বরুপের দর্শন করাবেন । অন্যথায় তিনি স্বীকার করে নেবেন যে তিনি সদগুরু নন বা তিনি স্বয়ং ঈশ্বরকে দর্শন করেন নি এবং তিনি তা করাতে অক্ষম । যদি তিনি শব্দের জ্বালে ভ্রমিত করবার চেষ্টা করেন, তাহলে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত । যিনি স্বয়ং মুক্তির আস্বাদ পান নি তিনি আমাদের ভব্বন্ধন থেকে মুক্ত করার কথা বলবেন কী করে ? নিঃসন্দেহে আমরা ঠগবাজ গুরুর পাল্লায় পড়েছি, তিনি আমাদের ধোকা দিচ্ছেন ।
ব্রহ্ম জ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
ব্রহ্মজ্ঞান(তত্ত্বজ্ঞান) পেতে আগ্রহী হলে ক্লিক করুন
এবারে দেখা যাক ঈশ্বর কোথায় নিবাস করেন ।
ঈশ্বর সর্বভুতানাং হৃদ্দেশোর্জুন ত্বিষ্ঠতি ।
(গীতা – ১৮/৬১)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন ঈশ্বর তো সমস্ত প্রাণীর হৃদয়ে(শাস্ত্রে হৃদয় বলতে হৃৎপিণ্ডকে বোঝায় না, দুই ভ্রূকুটির মধ্যবর্তী স্থান, যেখানে ত্রিনেত্র বা দিব্যচক্ষু রয়েছে) অন্তর্নিহিত রয়েছেন । একথাই উপনিষদেও বলা হয়েছে কিন্তু কীরূপে তাঁকে জানা যেতে পারে ?
ঈশ্বরের রূপ কী এবং কোথায় তিনি নিবাস করেন তা মহালয়ার এই মত্রে পরিস্কার ভাবে উল্লেখ রয়েছে ।
ইয়া দেবী সর্ব ভুতেষু জ্যোতিরূপেন সংস্থিতা ।
নমস্ত্যাস্যিয়াই নমস্ত্যাস্যিয়াই নমঃ নমাহাঃ ।।
– মহালয়া মন্ত্র
‘ইয়া’ অর্থাৎ এই, ‘দেবী’ অর্থাৎ ঈশ্বর, ‘সর্ব’ অর্থাৎ সমস্ত, ‘ভুতেষু, অর্থাৎ ভুতে বা বস্তুতে, ‘জ্যোতিরুপেন’ অর্থাৎ জ্যোতিরূপে, প্রকাশরূপে বা আলোর রূপে, ‘সংস্থিতা’ অর্থাৎ অবস্থিত বা বিরাজমান । নমস্ত্যাস্যিয়াই নমস্ত্যাস্যিয়াই নমঃ নমাহাঃ (সেই ঈশ্বরকে আমি বারবার নমস্কার করি । আমরা মহালয়ার মন্ত্রে উচ্চারন শুনছি, এই ঈশ্বর সমস্ত বস্তুতে জ্যোতিরূপে সর্বত্র বিরাজমান । আমরা সেই ঈশ্বরের জ্যোতিরূপকে নমস্কার করছি ।
কিন্তু বাস্তবে মন্দিরের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থিত মাটির রূপের প্রতিমাকেই প্রনাম করি । ঈশ্বরের ত্তত্বরূপ যে আসলে জ্যোতিরূপ, সেকথা কেউ বলে দিলেও তাঁর কথা আমরা মানতে চাই না কেন ? মাটির রূপকেই আমরা কেন আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ? সেই মাটির রূপেরই পূজা করে যেতে চাই । তাহলে আমাদের মন্ত্রের দ্বারা বলা এবং বাস্তবে কাজের মধ্যে পার্থক্য হয়ে গেল না কী ? এতে মা কী করে বা প্রসন্ন হবেন ? আমরা সেই দূর্গা মায়ের আসল জ্যোতির রূপকে জানিও না এবং কখনো জানবার চেষ্টাও করি নি ।
গীতাতেও সেই পরমাত্মাকে জ্যোতিস্বরূপ বলা হয়েছে ।
জ্যোতিষামপি, তজ্জোতিতমসঃ পরমুচ্চতে ।
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং জ্ঞানগম্যং হৃদি সর্বস্য বিস্ঠিতম ।। (গীতা – ১৩/১৭)
পরমাত্মা যিনি কিনা পরমজ্যোতি যাকে অন্ধকারের ’পরে অর্থাৎ উর্দ্ধে বলা হয়ে থাকে । ব্রহ্ম জ্ঞানের দ্বারাই সেই পরমাত্মা জানার যোগ্য । তাঁকে তত্ত্ব জ্ঞানের দ্বারা প্রাপ্ত করা হয়ে থাকে যিনি সবার হৃদয়ে সমাহিত রয়েছেন ।
“অসতো মা সদ্গময় তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যুর মা অমৃতমগময় ।”
‘অসতো’ অর্থাৎ অসত্য অর্থাৎ যা সত্য নয় অর্থাৎ জগতের সকল নশ্বর বা মিথ্যা বস্তুগুলি, ‘মা’ অর্থাৎ থেকে, ‘সদ্গময়’ সত্যের দিকে আমায় গমন করাও বা নিয়ে চল । ‘তমসো মা’ অর্থাৎ অন্ধকার থেকে, ‘জ্যোতির্গময়’ অর্থাৎ জ্যোতির বা আলোকের দিকে আমায় নিয়ে চল । একজন ভক্তের প্রার্থনা হল আমায় অসত্য থেকে সত্যের দিকে নিয়ে চল । আমায় অন্ধকার থাকে আলোর দিকে নিয়ে চল । আমায় মৃত্যুলোক থেকে অমরত্বের দিকে নিয়ে চল ।
কে আমাদের সেই অসত্য থেকে সত্যের সন্ধান দেবেন, কেই বা আমাদের মৃত্যুলোক থেকে অমরত্বের দিকে এবং জ্যোতি বা আলোকের দিকে নিয়ে যাবেন ? তাঁকে কী আমরা কখনো খোঁজার চেষ্টা করেছি ?
ব্রহ্ম জ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
ব্রহ্মজ্ঞান(তত্ত্বজ্ঞান) পেতে আগ্রহী হলে ক্লিক করুন
শাস্ত্রে তাঁকেই সদগুরু বলা হয়েছে যিনি আমাদের হৃদয়ের সেই অন্ধকার দূর করে দিয়ে সেই জ্যোতির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবেন । এবং আমাদের এই মৃত্যু সাগর থেকে মুক্ত করে অমরত্ত্বের পথ দেখাবেন ।
"বিন ভুমিকে মহল বনা তামে জ্যোতি উজারী রে ।
অন্ধা দেখ দেখ সুখ পাবে বাত বতাবে সারী রে ।।"
সেটা এমন এক মহল যা কিনা ভূমি ছাড়াই বানানো হয়েছে, যাতে সেই জ্যোতি অবিরাম জ্বলছে, যা অন্ধ ব্যক্তিও দেখেন এবং পরমানন্দকে প্রাপ্ত করেন । আমাদেরও সেই পরম জ্যোতিকে জানতে হবে ।
সেই “ভর্গো জ্যোতিকে” সেই “চানণ-কে” যাকে সন্ত মহাপুরুষগণ, ঋষি, গুরু ও অবতারগণ তাঁদের বাণীতে গেয়েছেন । এবং তখনই আমরা বলতে পারবো যে আমাদের পূর্ণ গুরুর প্রাপ্তি হয়েছে ।
একস্ত্বমাত্মা পুরুষঃ পুরাণঃ সত্যঃ স্বয়ংজ্যোতিরনন্ত আদ্দ্যঃ ।
– (শ্রীমদ্ভাগবত - ১০/১৪/২৩)
প্রভু আপনিই একমাত্র সত্য কারণ আপনিই হলেন সবার আত্মা । আপনিই পুরাণ পুরুষ হউয়ার কারণে সমস্ত জন্মাদি বিকার থেকে মুক্ত । আপনি স্বয়ং হলেন আদি অনন্ত জ্যোতি বা আলোক বা প্রকাশ । অন্য এক স্থানে বলা হয়েছে,
“গু অন্ধেরা জানিয়ে রু প্রকাশ”
– (কবীর)
গুরু = গু(অন্ধকার ) + রু (প্রকাশ বা আলোক বা জ্যোতি )
অর্থাৎ গুরু হলেন তিনি যিনি তৎক্ষণাৎ আমাদের ত্রিনেত্র খুলে দিয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে সেই ঈশ্বরীয় জ্যোতির দর্শন করাবেন । এখানে সংসারের বা ভৌতিক জগতের আলোর কথা নিশ্চয় বলা হয় নি । কারণ ভৌতিক জগতের আলো তো আমরা সবাই দেখেছি । এবং তা দেখার জন্য কোন প্রকার গুরুর প্রয়োজন হয় না বরং চোখ থাকলে আমরা নিজেরাই তা দেখতে পারি । গুরুই একমাত্র দীক্ষার দ্বারা আমাদের সেই ঈশ্বরীয় জ্যোতির দিকে নিয়ে যান ।
আমরা দুটি শব্দের কথা জানি একটি হল শিক্ষা এবং অপরটি হল দীক্ষা । শিক্ষা হল থিয়োরিটিক্যাল, অপরটি হল প্রাকটিক্যাল । আমরা কানে শুনে যা কিছু শিখি তা হল শিক্ষা । যা কিছু প্রত্যক্ষভাবে দেখি তা হল দীক্ষা । দীক্ষা শব্দটি সংস্কৃত ‘দিক’ ধাতু থেকে এসেছে যার অর্থ হল দেখানো । প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কী দেখানো ? গুরু দীক্ষার দ্বারা কী বা দেখাবেন । নিঃসন্দেহে এখানে সেই ঈশ্বরীয় জ্যোতির দর্শনের ইঙ্গিত করা হয়েছে । দীক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার দ্বারা ঈশ্বরের বা পারব্রহ্মের সেই অলৌকিক জ্যোতির দর্শন হয় । দীক্ষার সময় উপনয়ন শব্দটির ব্যবহার করা হয় যার দ্বারা উপরের নয়ন অর্থাৎ ত্রি-নয়ন বা ত্রিনেত্র বা দিব্য চক্ষুর ইঙ্গিত করা হয়েছে । যে নয়ন বা চক্ষু খুললে ঈশ্বরের সেই অলৌকিক জ্যোতির তৎক্ষণাৎ দর্শন হয় ।
ব্রহ্ম জ্ঞান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
ব্রহ্মজ্ঞান(তত্ত্বজ্ঞান) পেতে আগ্রহী হলে ক্লিক করুন
ছোটবেলায় আমাদের ধারাপাতে নামতা পড়ানোর সময় আমাদের ছন্দের তালে তালে পড়ানো হয় ১(এক)এ চন্দ্র অর্থাৎ একটি চাঁদের কথা বলা হয়েছে, ২(দুই)এ পক্ষ এখানে দুটি পক্ষ অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষ এবং শুক্লপক্ষের কথা বলা হয়েছে, ৩(তিন)এ নেত্র, আমরা তো দুটি চোখের কথা জানি, তাহলে তিনে নেত্র কেন বলা হয়েছে ? নিঃসন্দেহে তা ত্রিনেত্রের বা দিব্যচক্ষুর উল্লেখ করবার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে । ভগবান শিবের কিমবা মা পার্বতীর কপালে একটি চোখ দেখা যায় যাকে ত্রিনেত্র বলা হয় । এটা তারই ইঙ্গিত করার জন্য যে আমাদের প্রতিটি পুরুষ এবং মহিলারও সেই ত্রিনেত্র বা ত্রিনয়ন বা দিব্যচক্ষু রয়েছে । জন্ম থেকে সেটি বন্ধ থাকে । ব্রহ্মনিষ্ঠ সদগুরু দীক্ষার সময় ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা যখন সেই ত্রিনেত্র খুলে দেন, তখনই নিজের অন্তর্জগতে ঈশ্বরের অলৌকিক জ্যোতির দর্শন সম্ভব হয় । তার পূর্বে ঈশ্বরের দর্শন অসম্ভব ।
What is religion ? অর্থাৎ ধর্ম কী ? এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন Religion is realization of god. ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ অনুভুতি করাই হল ধর্ম ।
আদি শঙ্করাচার্য্য বিবেকচূড়ামণিতে অপরোক্ষ(অর্থাৎ প্রত্যক্ষ) অনুভুতির কথা উল্লেখ করেছেন । ইনারা সবাই ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করার জন্যই বারবার আহব্বান জানিয়েছান । কারণ দর্শন ছাড়া মুক্তি অসম্ভব । তিনি বলেছেন ব্রহ্মজ্ঞান বিনা মুক্তি অসম্ভব । ব্রহ্মজ্ঞান কী? ত্রিনেত্র বা দিব্যচক্ষু খুলে তৎক্ষণাৎ ঈশ্বর প্রত্যক্ষ করাই হল ব্রহ্মজ্ঞান ।
ধর্ম পিপাসু প্রতিটি ব্যক্তিকে মুক্ত আহ্বান জানানো যাচ্ছে আসুন আমরাও ঈশ্বর দর্শন করে ধর্মের লাভ উঠাই এবং বিশ্বশান্তির বিরাট মিশনে নিজস্ব যোগদান দিই।
বিশ্বশান্তি কীরূপে আসবে ।
--------ব্রহ্ম জ্ঞান থেকে ।
ব্রহ্মজ্ঞান কোথায় পাওয়া যাবে ?
--------দিব্য জ্যোতি জাগ্রতি সংস্থানে ।
আরো বিস্তারিত জানতে এবং ব্রহ্ম জ্ঞানে আগ্রহী হলে ক্লিক করুন |
[বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ পুরো নিবন্ধটির বিষয়বস্তু সম্পূর্ণটাই সংগৃহীত এবং বাংলাভাষী মানুষের বোধগম্যের উদ্দেশ্যে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে মাত্র। অনুবাদে কোনোরকম ভুল ত্রুটি থাকলে মার্জনা করবেন। অনুবাদ কর্তা লেখাটির বিন্দুমাত্র শ্রেয় দাবী করে না। যার কৃপায় অনুবাদ সম্ভব হলো তার সম্পূর্ণ শ্রেয় পাবার একমাত্র অধিকারী হলেন বর্তমান সময়ের একমাত্র পূর্ণযোগী সর্বশ্রী আশুতোষ জী মহারাজ। ]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন